
কেমন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন চাই এবং রাজনৈতিকভাবে কী করা উচিৎ? (পর্ব-০১)

জুলাই বিপ্লবের পর স্পষ্টতই দেশে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরী হয়েছে। রাজনৈতিক শূন্যতা বিপ্লবের আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে, জুলাই বিপ্লবের আগে সেই শূন্যতা ছিল প্রায় অসম্ভব আর এখনকার শূন্যতা অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। কেন সম্ভাবনাময়, সেটাই ব্যাখ্যা করছি।
আমরা দেখছি রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ জনসাধারণের কাছে আজ অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। এখনই আমি লীগের এপিটাফ লিখে ফেলতে চাচ্ছি না, তবে আমি মনে করি যে খুব বেশি হলে একটি প্রান্তিক পার্টিতে পরিণত হয়েই আওয়ামী লীগকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। জামায়াতে ইসলাম সহ ইসলামী দলগুলোর মধ্যে প্রবল মতবিররোধ বিদ্যমান। তদুপরি দেশের জনসাধারণের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তাও খুব বেশি না। বামদলগুলোর অবস্থা তথৈবচ। বহুদিন ধরেই তারা জনবিচ্ছিন্ন, তার উপর তাদের অনেকেই নানাভাবে বিভিন্ন সময় লীগের তল্পিবাহকের কাজ করে এসেছে। বিএনপি এই মুহর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। পরবর্তী নির্বাচনে তাদের আসার প্রবল সম্ভাবনা। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের এক বিরাট অংশই কিন্তু বিএনপি এর শাসনামল দেখে নাই। যার ফলে বিএনপি কেমন সেই বিষয়ে তাদের তেমন কোন ধারণাই নেই। যদিও জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি তৈরির পিছনে বিএনপির অবদান ছিল, কিন্তু আমি মনে করি শেষ পর্যন্ত বিএনপি যে আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পারে নাই, তার সম্ভাব্য বড় কারণ হচ্ছে তরুণদের সাথে বিএনপি কোন বোঝাপড়া তৈরি না করতে পারা। ফলে ছোটখাট কিছু সম্ভাবনা তৈরি হলেও সরকারের পতন হয় নাই। অতএব, আমরা ধরে নিতে পারি যে এই তরুণদের অনেকেই হবে সুইং ভোটার এবং খুব ভালো সম্ভাবনা আছে যে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের সামনে খুব ভালো কোন অপশন থাকবে না যদি না এর আগে কোন এক বা একাধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক দল গঠিত না হয়। উপরন্তু, গত ১৬ বছরের একটানা মামলা – হামলা – নির্যাতনে বিএনপি অনেকটাই দিশেহারা । এ মুহূর্তে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন তাই সময়ের দাবী।এখন প্রশ্ন আসে যে দল টি তাহলে কেমন হওয়া উচিত। আমার মতে নতুন দল এমন হওয়া উচিত যা কিনা বর্তমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তে একটা গুনগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম এবং যারা আদর্শের ফুলঝুরি না ফুটিয়ে জনগণের ভাষায় কথা বলে ভবিষ্যৎমুখী রাজনীতি করবে।
একটি পরিণত রাষ্ট্রের লক্ষণ হলো রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে কোন জোরালো বিতর্ক থাকবে না। মতাদর্শের লড়াই যে থাকে না, তা না; তবে সেটা অনেকটা সারফেস লেভেল এ। আমি জানি যে অনেকে এই মুহূর্তে LGBTQ ইস্যুসহ আরো নানা ইস্যু আনবেন, কিন্তু ওই যে বললাম এগুলা খুবই সারফেস লেভেলের ইস্যু। কেন সারফেস লেভেলের, সেটা এই মুহূর্তে আর আলোচনায় গেলাম না। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, মতাদর্শ-উত্তর একটি রাষ্ট্র কীভাবে গঠন করা যেতে পারে ? বা যদি আরেকটু সহজ করে বলি; কীভাবে একটা রাজনৈতিক দল মতাদর্শ-উত্তর রাজনীতি করতে পারে ? করার অন্যতম উপায় হতে পারে কর্মসূচীভিত্তিক রাজনীতি, যে কর্মসূচীর লক্ষ্য হবে ব্যক্তির সক্ষমতার বিকাশের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণ করা যেখানে মানুষ ছাড়াও প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষার নিশ্চয়তা থাকবে । নতুন বাংলাদেশ হবে এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে পরিশ্রম ও উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হবে এবং একই সাথে জনগণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। একটা কার্যকর রাষ্ট্র নির্মাণ করতে গেলে কিছু ব্যাপারে ন্যূনতম ঐকমত্য থাকতে হয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস নির্বিশেষে জান-মালের নিরাপত্তা, দ্রুত সুবিচার পাওয়ার নিশ্চয়তাসহ মৌলিক অধিকার এর নিশ্চয়তা, বাক-স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র। তাহলে এখন কথা হচ্ছে এরকম দল গঠনের উপায় কী ? যেহেতু আমরা গণতন্ত্র চাই, তাই দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা আবশ্যক। কীভাবে গণতন্ত্র চর্চা হতে পারে, সেটা দীর্ঘ আলোচনার ব্যাপার; তবে আলোচনা শুরু হওয়া দরকার। এই মুহূর্তে গণতন্ত্রপন্থী দলগুলোর সাথে, বিশেষ করে নতুন দলগুলোর সাথে ভালো একটা শুরু হতে পারে। সেই সাথে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও untapped অংশের সাথে engage হওয়াটাও জরুরী। একটা ব্যাপার বুঝা দরকার যে untapped অংশ সবসময় যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হবে তা নয়। Untapped অংশ হচ্ছে তারাই যাদেরকে আমরা সাধারণত রাজনৈতিকভাবে ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না কিন্তু তাদেরও এজেন্সি থাকতে পারে। এতক্ষণ ধরে যা যা আলোচনা করলাম, সেগুলা কোনভাবেই exhaustive না। তবে রাজনৈতিকভাবে আমাদের পথচলার একটা দিকনির্দেশনা হতে পারে। মনে রাখতে হবে রাজনীতির মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার শুধু রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেওয়াটা দুর্ভোগের কারণ হতে পারে।
এবার আসি মধ্যপন্থার ব্যাপারে। আজকাল অনেকেই মধ্যপন্থী দল করার কথা ভাবছেন। কথা হচ্ছে মধ্যপন্থাটা কী ? অনেকে হয়তো বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে বলবেন মধ্যপন্থা হচ্ছে ডানের বামে এবং বামের ডানে থাকা কোন একটা পন্থা। কিন্তু আসলেই কী তাই ? ডানের বামে এবং বামের ডানে থাকাটা কিন্তু আদর্শিকভাবে খুব আকর্ষণীয় কিছু না। তাহলে মধ্যপন্থার আকর্ষণটা কী ? মধ্যপন্থার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে বা হওয়া উচিৎ কর্মসূচী। সেই কর্মসূচী হবে সরাসরি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন-কেন্দ্রিক। তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বাম বা ডান দলগুলো কী কোন কর্মসূচী দেয় না? অবশ্যই দেয়; কিন্তু সেগুলা অনেক সময় আদর্শিক দ্বন্দ্বের বাতাবরণে ঢাকা পড়ে যায়। আর এখানেই বাম বা ডান দলগুলোর সাথে মধ্যপন্থী দলগুলোর পার্থক্য। যেহেতু একটা মধ্যপন্থী দল কর্মসূচীভিত্তিক, তাই দেশ ও জাতির প্রয়োজনে অনেক সময় বাম বা ডান দলগুলার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারে। এতে করে দেশ ও জাতিরও উপকার হয়, সেই সাথে অহেতুক কালচারাল ওয়ার থেকেও আমরা রেহাই পেতে পারি। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে গত ১৬ বছর লীগ সরকার এসব কালচারাল ওয়ার এর মাধ্যমেই জনগণকে ব্যস্ত রেখেছিলো। এরই মাঝে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিল। এর মানে দাঁড়ায় এই যে, একটা নতুন রাজনৈতিক দল বা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের রাজনৈতিক দল হওয়া উচিত মধ্যপন্থী।
পরবর্তীতে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা ও অন্তরায় নিয়ে আলোচনা করবো।