১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান: ভারতীয় আধিপত্য ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম

Spread the freedom

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এই যুদ্ধ শুধু একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম ছিল না, এটি ছিল একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের আধিপত্য ও প্রভাব। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এই নিবন্ধে আমরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভারতীয় আধিপত্য এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করব।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ: স্বাধীনতার সূচনা

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। পাকিস্তানের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়ায়। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এই যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা অপরিসীম। ভারত শরণার্থী আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। তবে এই সহযোগিতার পেছনে ভারতের নিজস্ব রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থও কাজ করেছিল।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়: ভারতের প্রভাব

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক জটিল হয়ে ওঠে। ভারতের সহযোগিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সচেষ্ট হয়। তবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে নদী জল বণ্টন, সীমান্ত সমস্যা, বাণিজ্য ঘাটতি ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশকে ভারতের উপর নির্ভরশীল হতে হয়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে ভারতের প্রভাব কিছুটা কমলেও ১৯৯০-এর দশকে পুনরায় তা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারগুলোর সময় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়।

ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংগ্রাম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একটি চলমান প্রক্রিয়া। নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলোতে এই সংগ্রাম বিশেষভাবে লক্ষণীয়:

১. নদী জল বণ্টন ও তিস্তা চুক্তি

তিস্তা নদীর জল বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়ে ভারতের সাথে আলোচনা চালিয়ে গেলেও এখনও কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি।

২. সীমান্ত সমস্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা একটি বড় সমস্যা। এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার বারবার প্রতিবাদ জানালেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি।

৩. বাণিজ্য ঘাটতি

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশ ভারত থেকে প্রচুর পণ্য আমদানি করলেও রপ্তানি খুবই কম। এই বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করছে।

৪. সাংস্কৃতিক আধিপত্য

ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রভাব বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। ভারতীয় টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও সংগীত বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করছে। এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকর্মীরা সচেতনভাবে কাজ করছেন।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান: নতুন সংগ্রামের সূচনা

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই অভ্যুত্থানের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও অসন্তোষ। ভারতীয় আধিপত্য, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এই অভ্যুত্থানের মূল কারণ।

এই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় সচেতন হয়েছে। তারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের দাবি জানিয়েছে।

উপসংহার

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাস ভারতীয় আধিপত্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আজও সংগ্রাম করে চলেছে। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান এই সংগ্রামের একটি নতুন অধ্যায়। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় সচেতন হয়েছে এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষ তাদের ঐক্য ও সংহতি প্রদর্শন করেছে। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আরও সচেতন ও সংগঠিত হবে।


Spread the freedom

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *