বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে কোন সংস্কার জরুরি? | বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন

Spread the freedom

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু বিগত কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে উদ্বেগ ও বিতর্ক দেখা গেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থায় জরুরি কিছু সংস্কার এখন সময়ের দাবি। এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে ঠিক কোন কোন দিক থেকে সংস্কার প্রয়োজন এবং কেন।

১. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা

নির্বাচন কমিশনের আইনি কাঠামো:

বর্তমান আইনে নির্বাচন কমিশন গঠনের পদ্ধতি স্বচ্ছ নয় বলে অনেকেই মনে করেন। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সাংবিধানিক ও আইনগত সংস্কার প্রয়োজন।

বাজেট ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা:

ইসি যেন সরকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়, সে জন্য কমিশনের বাজেট বরাদ্দ সংসদের মাধ্যমে নির্ধারণ এবং প্রশাসনিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

২. রাজনৈতিক সংস্কার

দলীয় শৃঙ্খলা বনাম গণতান্ত্রিক চর্চা:

রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব স্পষ্ট। মনোনয়ন পদ্ধতি, নেতৃত্ব নির্বাচন ইত্যাদিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দলীয় সংস্কার প্রয়োজন।

সহিংসতার অবসান:

নির্বাচনের আগে ও পরে রাজনৈতিক সহিংসতা রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।

৩. প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা

আমলাতন্ত্রের ভূমিকা:

নির্বাচনের সময় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রভাবিত আমলারা অনেক সময় পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করেন। এর জন্য প্রশাসনিক নিয়োগ ও বদলিতে স্বচ্ছতা দরকার।

নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা:

নিরাপত্তা বাহিনী যেন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে তা নিশ্চিত করতে নির্বাচনকালীন সময়ে স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে।

৪. ভোটার তালিকা ও ইলেকট্রনিক ভোটিং

নির্ভুল ভোটার তালিকা:

ভোটার তালিকা যেন সঠিক ও হালনাগাদ থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

ইভিএম ব্যবহার:

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (EVM) নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সঠিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা এবং সব দলের সমর্থন নিশ্চিত করে তা ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫. প্রচার প্রচারণা ও মিডিয়া ভূমিকা

প্রচারের সমান সুযোগ:

সব দল ও প্রার্থীদের সমান প্রচার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি সুবিধার অপব্যবহার রোধে কঠোর নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ দরকার।

মিডিয়ার স্বাধীনতা ও দায়িত্ব:

সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়ার নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

৬. সিভিল সোসাইটি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক

সুশীল সমাজের ভূমিকা:

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ, ভোটার সচেতনতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে সুশীল সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদের কার্যক্রমে বাধা না দিয়ে সহায়তা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ:

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নির্বাচনকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। এজন্য তাদের সহজে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

৭. আইনগত কাঠামোর সংস্কার

নির্বাচনী আইন সংস্কার:

নির্বাচনী অপরাধ, ব্যয় নির্ধারণ, প্রচারের সীমা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিদ্যমান আইনে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। এসব সংশোধন করে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন প্রয়োজন।

বিচার বিভাগের ভূমিকা:

নির্বাচনি বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালগুলো যেন নিরপেক্ষ ও দক্ষভাবে কাজ করে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

উপসংহার:

বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে একটি সামগ্রিক ও সুপরিকল্পিত নির্বাচন সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। এই সংস্কার শুধু নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসনের নয়, বরং রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগেই বাস্তবায়ন সম্ভব। এখনই সময় ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ে তোলার।


Spread the freedom

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *