
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জুলাই ২০২৪ প্রতিশ্রুতি ও বর্তমান বাস্তবতা।

২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনার কাল। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধী দলের দমন, আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা যেন ছিল এক আশার আলো। সরকার আশ্বাস দিয়েছিল—একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নির্বাচন হবে জুলাই ২০২৪-এর মধ্যেই। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এই ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। দেশের জনগণ আশাবাদী হয়েছিল—এবার হয়তো সত্যিকারের একটি গণতান্ত্রিক পরিণতি আসতে চলেছে।
কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, সেই আশ্বাস ততই ফিকে হয়ে গেছে। আজ, যখন আমরা জুন ২০২৫-এর দ্বারপ্রান্তে, তখন স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে—সেই ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার আসলে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার এক কৌশলী ছদ্মবেশ মাত্র। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠনের নামে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি এড়িয়ে যাওয়া। জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে আবারও ক্ষমতায় থাকার নীলনকশা বাস্তবায়ন।
জুলাইয়ের প্রতিশ্রুতি: কৌশল না কর্তব্য?
জুলাই ২০২৪ নির্বাচন নিয়ে সরকারের ঘোষণাকে অনেকেই প্রথমদিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল। দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো—বিশেষ করে বিএনপি—তাতে সশরীরে অংশ না নিলেও একে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোও চোখ রেখেছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথে। জাতিসংঘের বাংলাদেশবিষয়ক বিশেষ দূত সেসময় প্রকাশ্যে বলেছিলেন, “এই সরকারকে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন মনে করি, তাদের প্রধান দায়িত্ব নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম করা।”
কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি যখন সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া, সময়সীমার চূড়ান্ত ঘোষণা ছাড়া, এবং রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে বাস্তব আলোচনার অভাবে ধোঁয়াশায় পরিণত হতে শুরু করল, তখন অনেকে বুঝতে শুরু করল—এই প্রতিশ্রুতি আসলে ক্ষমতাকে লেজিটিমাইজ করার এক কৌশল মাত্র। একদিকে নির্বাচনের আশ্বাস, অন্যদিকে বিরোধী দলের ওপর মামলা, গ্রেপ্তার, গুম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে দমন—এই দ্বৈত নীতির মধ্যে দিয়ে সরকার যে একটি ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের পথে হাঁটছে, তা আজ আর কারো অজানা নয়।
নির্বাচনবিহীন শাসনব্যবস্থা: দমননীতি ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব ছিল নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু বাস্তবে তারা যা করেছে তা হলো—নির্বাচনের বদলে শাসনের চেষ্টা। প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা দলীয়করণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহার, নির্বাচনী কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা—সবকিছু মিলিয়ে একটি গণতন্ত্রহীন, জনগণবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র পরিচালনার ছক বাস্তবায়িত হয়েছে।
অভিযোগ আছে, বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয়, বরং ‘ছদ্মনামে চিরস্থায়ী সরকার’। তাদের কার্যক্রম দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে তারা কোনও নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছেন; বরং প্রতিটি পদক্ষেপ এমনভাবে সাজানো হচ্ছে যেন নির্বাচন ছাড়া একটি দীর্ঘকালীন ক্ষমতাধারিত সরকার টিকিয়ে রাখা যায়। বিরোধী নেতাদের গৃহবন্দী অবস্থা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নজরদারি ও সেন্সরশিপ—এসব এই ধারণাকেই মজবুত করছে।
জনগণের ওপর চাপের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে এখন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত রাজনৈতিক মন্তব্য করতে ভয় পায়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরোধীমতের ছাত্রদের উপর দমন, বিচারহীন গুম, বিদেশে আশ্রয় নেয়া রাজনৈতিক কর্মীদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কণ্ঠরোধ—এসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় ১৯৮০-এর দশকের সামরিক শাসনের দিনগুলোর কথা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্বাসহীনতার উত্থান
২০২৪ সালের জুলাই-এর আশ্বাসের পর আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের ওপর কিছুটা ভরসা রেখেছিল। কিন্তু আজ সেই ভরসা ক্ষয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার ভিসানীতি প্রয়োগ করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন হুমকি দিয়েছে উন্নয়ন সাহায্য কমানোর, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার। তাদের একমাত্র লক্ষ্য নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা।
চীন ও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে, কিছু মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দেশের সাথে চুক্তি করে সরকার হয়তো আন্তর্জাতিক চাপ থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু জনসমর্থনহীন এক সরকারের টিকে থাকা শুধু বাইরের শক্তির উপর নির্ভর করে বেশি দূর যেতে পারে না।
আজ বাংলাদেশ এমন এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দুর্বল, আর জনগণের আস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে।
নির্বাচনের নামে প্রতারণা: ভবিষ্যতের জন্য হুমকি
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে “নির্বাচনের অভিভাবক” হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তারা আসলে নির্বাচন থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে চায়। নির্বাচনের দিনক্ষণ নেই, অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ নেই, নেই কোনো স্বাধীন পর্যবেক্ষকের নিশ্চয়তা—তবে কি সরকার নিজেই নির্বাচন নয়, নির্বাচনহীনতা চায়?
বিরোধী দলগুলো বহুদিন ধরে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে, এই অন্তর্বর্তী সরকার সেই চাহিদাকে ধোঁয়াশায় ফেলে আসলে শাসন দীর্ঘায়িত করার ফাঁদ তৈরি করেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে এই অবস্থান ভয়াবহ এক বিভাজন সৃষ্টি করছে। আগামী প্রজন্ম যখন এই সময়ের ইতিহাস পড়বে, তারা হয়তো বলবে—একটি জাতি যেটি এত রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছে, তারা কীভাবে আবার সেই স্বাধীনতাকে গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থে বিলিয়ে দিল?
উপসংহার: জবাবদিহিতাহীনতা থেকে গণজাগরণে ফেরার আহ্বান
বর্তমান সরকার যদি সত্যিই অন্তর্বর্তী হয়ে থাকে, তাহলে তাদের কাজ নির্বাচন আয়োজন এবং তারপর সরে যাওয়া। কিন্তু বাস্তবতা বলছে—তারা সেই কাজের পথে নেই। বরং তারা জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে পায়ে দলে একদলীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের জনগণের সামনে এখন দুটি পথ—এক, নিরব থেকে আরও একটি স্বৈরশাসনের যুগে প্রবেশ; দুই, গণজাগরণ সৃষ্টি করে, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই শাসকগোষ্ঠী জনগণকে উপেক্ষা করেছে, তখনই জনতার শক্তি তাদের মসনদ টলিয়ে দিয়েছে।
অতএব, আজ প্রয়োজন তীক্ষ্ণ সচেতনতা, দৃঢ় অবস্থান এবং সত্য উচ্চারণের সাহস। কারণ গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়—এটি একটি প্রক্রিয়া, একটি জীবনধারা। আর সেই প্রক্রিয়াকে পুনরুদ্ধার করতে হলে আমাদের একসাথে বলতে হবে—আমরা আর ঠকতে চাই না। আমরা আবার ভোটাধিকার চাই, ন্যায়বিচার চাই, এবং এক সত্যিকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাই, যারা শুধু প্রতিশ্রুতি নয়—তার বাস্তবায়নও করবে।