রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মানবিক করিডোর: প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্য ঝুঁকি

Spread the freedom

একটি অনন্তকালীন সংকটের মুখোমুখি

২০১৭ সালের সেই ভয়াবহ আগস্ট মাসটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নৃশংস “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” এর শিকার হয়ে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছিল, তখন বিশ্ব সম্প্রদায় মাত্রই উপলব্ধি করতে শুরু করেছিল এই সংকটের গভীরতা। আজ ছয় বছর পরও এই সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দেখা যাচ্ছে না। বরং দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে পরিস্থিতি।

বর্তমানে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বাস করছে প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (UNHCR) তথ্য অনুযায়ী, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং দ্রুততম বেড়ে ওঠা শরণার্থী শিবির। কিন্তু প্রশ্ন হলো – কতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভার বহন করতে পারবে? এই সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজতে গিয়েই আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনায় এসেছে “মানবিক করিডোর” ধারণাটি।

রোহিঙ্গা সংকটের ঐতিহাসিক পটভূমি

১.১ একটি জাতির অস্তিত্বের সংকট: রোহিঙ্গাদের হারানো ইতিহাস

রোহিঙ্গাদের ইতিহাস বিতর্কে জড়িয়ে থাকা একটি বিষয়। মিয়ানমার সরকার দাবি করে যে রোহিঙ্গারা মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে (১৮২৪-১৯৪৮) বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। কিন্তু ঐতিহাসিক নথিপত্র বলছে ভিন্ন কথা। আরব বণিকদের লেখা দশম শতকের ভ্রমণকাহিনীতে রাখাইন অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়ের উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগে বাংলার সুলতানদের সাথে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত।

১৭৮৪ সালে যখন বর্মী রাজা বোদাওফায়া রাখাইন দখল করেন, তখন থেকেই শুরু হয় রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়নের ইতিহাস। কিন্তু ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর প্রথম সংবিধানে রোহিঙ্গাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। পরিস্থিতি বদলায় ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদেরকে “জাতিগত শ্রেণী” থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই আইনে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের স্থান হয়নি তালিকায়।

১.২ সাম্প্রতিক সহিংসতার ক্রমবিকাশ

২০১২ সালের রাখাইন দাঙ্গা ছিল রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে সীমান্তে পুলিশ চৌকিতে হামলার পর সেনাবাহিনী “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” শুরু করে। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ARSA (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) নামক বিদ্রোহী গ্রুপের হামলাকে কেন্দ্র করে যা ঘটে যায়, তা ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ জাতিগত সহিংসতা।

জাতিসংঘের তদন্তকারীরা পেয়েছেন:

৩৯২টি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল

৬,৭০০ জনের বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছিল (সংখ্যাটি প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি হতে পারে)

৭২০ জনের বেশি শিশুকে তাদের পরিবারের সামনেই হত্যা করা হয়েছিল

৬৩০ জন নারী ও মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল

১.৩ বাংলাদেশের উপর প্রভাব: একটি বহুমাত্রিক সংকট

অর্থনৈতিক প্রভাব

বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রতিদিন প্রায় ৩.৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এই সংকটের জন্য প্রায় ৭.২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা দেশের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ২৩%।

পরিবেশগত বিপর্যয়

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ৬,০০০ একর বনভূমি উজাড় হয়েছে শরণার্থী শিবিরের জন্য। এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। IUCN-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বন উজাড়ের ফলে কমপক্ষে ১৩টি বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী তাদের আবাসস্থল হারিয়েছে।

সামাজিক উত্তেজনা

স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে রোহিঙ্গাদের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের এক জরিপে দেখা গেছে:

৮৯% স্থানীয় বাসিন্দা মনে করেন রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি তাদের জীবিকার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে

৭৬% মনে করেন এটি অপরাধ বৃদ্ধির কারণ হয়েছে

৬৮% স্থানীয় নারী মনে করেন তাদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে

মানবিক করিডোর – ধারণা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

২.১ মানবিক করিডোর: একটি আন্তর্জাতিক ধারণার উৎপত্তি

মানবিক করিডোরের ধারণাটি নতুন নয়। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের জেনেভা কনভেনশনের (১৯৪৯) বিভিন্ন ধারায় এর আইনি ভিত্তি রয়েছে। তবে বাস্তবে এর প্রথম সফল প্রয়োগ দেখা যায় ১৯৯০-এর দশকের বসনিয়া যুদ্ধের সময়।

২০১৪ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় আলেপ্পো শহরে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে:

৩৫,০০০ বেসামরিক নাগরিককে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল

২,৫০০ টন মানবিক সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়েছিল

৪০০ জনের বেশি গুরুতর অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসার জন্য বের করে আনা হয়েছিল

২.২ রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে মানবিক করিডোরের প্রস্তাব

২০২০ সালে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি প্রথম রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মানবিক করিডোরের প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাবের মূল উপাদানগুলো হলো:

১. ভৌগলিক সীমানা: বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টকে করিডোর হিসেবে চিহ্নিত করা
২. সময়সীমা: প্রাথমিকভাবে ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য করিডোর সক্রিয় রাখা
৩. অংশগ্রহণকারী: জাতিসংঘ, ICRC, ASEAN এবং স্থানীয় সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক কমিটি
৪. কার্যক্রম:

রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন

মিয়ানমারে তাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রাথমিক অবকাঠামো তৈরি

নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা

মানবিক করিডোরের প্রয়োজনীয়তা

৩.১ বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের জন্য এই করিডোর অত্যন্ত জরুরি কারণ:

অর্থনৈতিক চাপ: প্রতি বছর গড়ে ১.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে শরণার্থীদের জন্য

নিরাপত্তা ঝুঁকি: শিবিরগুলোতে সন্ত্রাসী গ্রুপের অনুপ্রবেশের খবর পাওয়া যাচ্ছে

সামাজিক অস্থিরতা: স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে

৩.২ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব

জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন (১৯৫১) এবং এর ১৯৬৭ সালের প্রটোকল অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবে এই দায়িত্বের বেশিরভাগই বাংলাদেশের উপর বর্তেছে।

বাস্তবায়নের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

৪.১ মিয়ানমারের অনীহা

মিয়ানমার সরকার এখনও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তাদের অবস্থান হলো:

রোহিঙ্গারা অবৈধ অভিবাসী

তাদের ফেরত নেওয়া হবে কিন্তু নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না

শুধুমাত্র যারা ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের শর্ত পূরণ করে তাদের ফেরত নেওয়া হবে

৪.২ রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছা

UNHCR-এর জরিপে দেখা গেছে:

৯৬% রোহিঙ্গা ফিরতে চায় না যদি না তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়

৮৯% নারী তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত

৭৮% পরিবার ভূমি ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে

সম্ভাব্য সমাধানের পথ

৫.১ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা তীব্রতর করা

বাংলাদেশকে নিম্নলিখিত কৌশল অবলম্বন করতে হবে:

OIC এবং ASEAN-এর মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি

চীন ও রাশিয়ার সাথে আলোচনা তীব্রতর করা

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই ইস্যুটি নিয়মিত তোলা

৫.২ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিতে হবে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ:

মিয়ানমারের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি রাখা

আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা জোরদার করা

মানবিক সহায়তা বাড়ানো

উপসংহার

একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে

মানবিক করিডোর রোহিঙ্গা সংকটের একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে, তবে এর সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। বাংলাদেশ একা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। বিশ্ব সম্প্রদায়কে তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং মিয়ানমারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

এই দীর্ঘ নিবন্ধে আমরা দেখেছি কিভাবে একটি মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এটি কোনো সহজ প্রক্রিয়া নয়। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার।

তথ্যসূত্র

  1. UNHCR. (2022). Rohingya Refugee Crisis Explained
  2. Human Rights Watch. (2018). “All of My Body Was Pain”: Sexual Violence against Rohingya Women and Girls in Burma
  3. Amnesty International. (2017). Myanmar: The Rohingya Minority – Fundamental Rights Denied
  4. International Crisis Group. (2020). Building a Better Future for Rohingya Refugees in Bangladesh
  5. Ministry of Foreign Affairs, Bangladesh. (2021). Rohingya Crisis: Bangladesh Perspective

Spread the freedom

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *