
গণতন্ত্র না ক্ষমতার খেলা? ইশরাক হোসেনের মেয়র হওয়ার চেষ্টা ও নাগরিক অধিকার হরণ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘জনপ্রতিনিধি’ শব্দটি প্রায়শই ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যখন এই ক্ষমতার খায়েশ মানুষের মৌলিক নাগরিক সেবাকে অস্বীকার করার পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন বিষয়টি আর কেবল রাজনীতি থাকে না — এটি হয়ে ওঠে নৈতিকতা, প্রশাসন এবং মানবাধিকারের এক ভয়াবহ লঙ্ঘন। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের মেয়র হওয়ার প্রচেষ্টা বর্তমানে ঠিক এমনই এক সংকটের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবনসহ ১০টি আঞ্চলিক অফিস এক মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ। এই অচলাবস্থা কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং এটি নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি এক প্রকার প্রতারণা।
অবস্থাটি এমন এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষ জীবনের জরুরি প্রয়োজনে সরকারি সেবাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নাগরিকত্ব সনদ, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সেবাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নানান রকম ব্যক্তিগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। অথচ এই সমস্ত কিছুর পেছনে দায়ী একজন ব্যক্তি — ইশরাক হোসেন, যিনি একবার পরাজিত হওয়ার পর আবার মেয়র হওয়ার আশায় প্রশাসনিক প্রক্রিয়া পঙ্গু করে তুলেছেন।
নাগরিক দুর্ভোগ: প্রশাসনিক অচলাবস্থার মানবিক ট্র্যাজেডি
যেকোনো মহানগর ব্যবস্থাপনায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিক সনদ বা ট্রেড লাইসেন্সের মতো মৌলিক সেবা একটি শহরের হৃদপিণ্ডের মতো। যখন এই সেবাগুলো বাধাগ্রস্ত হয়, তখন গোটা শহরের স্বাভাবিক ছন্দ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পুরান ঢাকার এক অধিবাসীর কাহিনী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই অচলাবস্থা কেমন ট্র্যাজেডিতে রূপ নিচ্ছে। তিনি বলেছেন,
“আমার ছোট শিশু গুরুতর অসুস্থ। পাসপোর্ট করে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য নিতে হবে। এ জন্য জন্মসনদ লাগবে। ২৫ দিন ধরে জন্মসনদ নিতে না পারায় পাসপোর্টের আবেদনই করতে পারছি না। অথচ দিন দিন আমার মেয়ের অবস্থার অবনতি হচ্ছে।”
এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট বুঝতে যে, কেবল প্রশাসনিক বন্ধ থাকলেই জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয় না; অনেক সময় এটি জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে পরিণত হয়। প্রশ্ন উঠছে — একজন রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কতদূর গ্রহণযোগ্য, যদি তা অন্যের মৌলিক অধিকার হরণ করে?
শুধু জন্মসনদ নয়, ব্যবসায়ী শ্রেণি ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন; বিদেশে যেতে ইচ্ছুকরা নাগরিকত্ব সনদ না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের ফ্লাইট মিস করছেন। সিটি কর্পোরেশনের দৈনন্দিন সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে কেবল ফাইল জমা দিতে না পারা নয় — বরং এটি নাগরিক জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়ায় প্রশাসনিক দুর্বলতা
বর্তমানে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। মেয়াদোত্তীর্ণ একটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ইশরাক হোসেন দাবি করছেন, পূর্ববর্তী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবৈধ ছিল এবং সে কারণেই তিনি এখন মেয়র পদে দায়িত্ব নিতে চান। এই যুক্তি কতটুকু আইনগত বা নৈতিক, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিন্তু ততদিনে নাগরিকেরা ভোগ করছেন চরম ভোগান্তি।
এখানে প্রশ্ন উঠছে: নাগরিকদের সেবা কি একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক মতাদর্শের কাছে জিম্মি থাকবে? যে ব্যক্তি এখনও নির্বাচিত নন, কেবল রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় রয়েছেন, তার জন্য গোটা প্রশাসন পঙ্গু হয়ে যাওয়া কেবল অপ্রত্যাশিত নয় — এটি নাগরিকতার ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এছাড়াও, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কেন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এক ব্যক্তির দাবির মুখে কার্যত অচল হয়ে পড়ে? এটি কেবল একজন নেতার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, বরং পুরো প্রশাসনের দুর্বল ব্যবস্থাপনারও পরিচয় বহন করে।
মেয়র হওয়ার যোগ্যতা ও নৈতিকতা: প্রশ্নবিদ্ধ ইশরাক হোসেন
একজন রাজনীতিবিদের মূল দায়িত্ব হলো জনসেবা। যদি কেউ মেয়র হতে চায়, তবে তার আগে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি জনগণের কল্যাণে কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু ইশরাক হোসেনের বর্তমান কার্যক্রম ঠিক তার বিপরীত ইঙ্গিত দেয়। নাগরিক সেবা বন্ধ করে, প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে, হাজার হাজার নাগরিককে দুর্ভোগে ফেলে দিয়ে যদি তিনি মেয়র হতে চান, তবে প্রশ্ন উঠবে — নির্বাচিত হওয়ার পরেও তিনি কী আদৌ নাগরিকদের কল্যাণে কাজ করবেন?
রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে — এটা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতা যদি জনস্বার্থের পরিপন্থী হয়, তবে তা গণতন্ত্র নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার। ইশরাক হোসেনের বর্তমান কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে তিনি নিজের স্বার্থকে জনগণের স্বার্থের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এটি কেবল অযোগ্যতা নয়, এটি নৈতিক দুর্বলতারও পরিচয়।
নগরবাসীর উপর এমন অবিচার চালিয়ে, মানবিক সঙ্কট তৈরি করে, রাজনৈতিক অবস্থান নিতে গিয়ে যদি তিনি সত্যিকার অর্থে মেয়র হতে চান, তবে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ও উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তোলা অনিবার্য।
উপসংহার: গণতন্ত্রের নাম ভাঙিয়ে গণবিরোধিতা
এই সমগ্র ঘটনাপ্রবাহ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কীভাবে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ক্ষমতার মোহ নাগরিক অধিকারকে পদদলিত করে। রাজনীতিকে যদি জনসেবা নয় বরং ব্যক্তি-সেবায় পরিণত করা হয়, তাহলে তা গণতন্ত্রের আত্মাকে আঘাত করে।
ইশরাক হোসেনের কর্মকাণ্ড, তাঁর প্রশাসনিক অবরোধ, এবং নাগরিক দুর্ভোগের বাস্তবতা থেকে আমরা বুঝি — গণতন্ত্র তখনই কার্যকর, যখন তাতে জনগণের সুবিধা অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু যখন সেই গণতন্ত্রের আড়ালে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কেবল নিজের খায়েশ পূরণে নাগরিকদের দুর্ভোগে ফেলেন, তখন প্রয়োজন জনতার জবাবদিহিতা।
নগরবাসীর উচিত এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সরব হওয়া, কারণ যদি আজ এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ না হয়, তবে আগামীকাল আরও বড় সংকট আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে গিলে ফেলবে। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে আমাদের আগে ‘গণ’-এর কথা ভাবতে হবে, আর সেই গণ মানেই — নাগরিক।