বাংলাদেশে ২০২৫ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বই বিতরণ ব্যর্থতা: কারণ ও প্রতিকার

Spread the freedom

ভূমিকা

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো সময়মতো পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে নির্ধারিত সময়ে বই বিতরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার, যা শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের জন্য এক বিশাল উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঠ্যপুস্তক বিলম্বিত হওয়ার কারণে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা ভবিষ্যতে আরও গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

এই প্রতিবেদনে ২০২৫ সালের পাঠ্যপুস্তক বিতরনে বিলম্বের মুল কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি এবং এর সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি এড়ানো যায়।


বই বিতরণে বিলম্বের প্রধান কারণসমূহ

বিদেশে মুদ্রণ বন্ধ হওয়া

বাংলাদেশে আগে পাঠ্যপুস্তকের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে মুদ্রিত হতো। এতে সময় এবং মান নিয়ন্ত্রণ সহজতর করা সম্ভব হতো। তবে ২০২৫ সালে সরকার দেশীয় মুদ্রণ শিল্পকে উৎসাহিত করতে বিদেশে বই মুদ্রণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো এত বিশাল সংখ্যক বই সময়মতো উৎপাদন করতে প্রস্তুত ছিল না। ফলে বই মুদ্রণের পুরো প্রক্রিয়াতেই বিলম্ব ঘটে।

শিক্ষাক্রম পরিবর্তন এবং নতুন বই সংযোজন

২০২৩ সালে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়, যা ২০২৫ শিক্ষাবর্ষেও প্রভাব ফেলেছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে অনেক নতুন বই সংযোজন করা হয়েছে এবং বেশ কিছু পুরনো বই সংশোধন করা হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলোর কারণে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের সময়সীমা বাড়তে থাকে, যা সময়মতো বিতরণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে।

সময়ের অভাব এবং পরিকল্পনার দুর্বলতা

পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও বিতরণ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হলেও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবের কারণে মুদ্রণ সময়সীমা মানা সম্ভব হয়নি। এনসিটিবি (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) এবং মুদ্রণশিল্পের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় না থাকায় সময়মতো বই সরবরাহ সম্ভব হয়নি।

কাগজের ঘাটতি ও মানসম্পন্ন মুদ্রণ জটিলতা

উন্নত মানের কাগজের ঘাটতি ছিল আরেকটি প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশে বেশিরভাগ কাগজ আমদানির উপর নির্ভরশীল, কিন্তু ২০২৫ সালে কাগজ আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে কাগজের সংকট দেখা দেয়। এছাড়াও, উন্নতমানের মুদ্রণ নিশ্চিত করতে গিয়ে সময় বেশি লেগেছে, যা পুরো প্রক্রিয়াকে আরও বিলম্বিত করেছে।

প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতি

প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতাও পাঠ্যপুস্তক বিতরণে দেরির অন্যতম কারণ। এনসিটিবি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে বই বিতরণ প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হয়েছে। ঠিকাদার ও মুদ্রণ সংস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা না থাকায় বই সরবরাহে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণ ব্যবস্থার সমস্যা

শুধু মুদ্রণই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বই পৌঁছানোর প্রক্রিয়াতেও ত্রুটি দেখা গেছে। পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে অনেক অঞ্চলের স্কুলে সময়মতো বই পৌঁছেনি। বিশেষ করে, গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।


বই বিতরণ বিলম্বের পরিণতি

শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব

শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বই না পাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। অনেক শিক্ষার্থী অনলাইনে বই ডাউনলোড করতে পারে না বা বইয়ের অনুপস্থিতিতে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

অভিভাবকদের অতিরিক্ত ব্যয়

বই না পাওয়ায় অনেক অভিভাবক বেসরকারি মুদ্রিত বই কিনতে বাধ্য হয়, যা তাদের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ হয়। এটি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বিশেষভাবে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

শিক্ষকদের পাঠদান প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন

বই না থাকায় শিক্ষকরা সঠিকভাবে পাঠদান করতে পারেন না। শিক্ষার্থীরা বই ছাড়া পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে না, ফলে পাঠদানেও বিঘ্ন ঘটে।


সম্ভাব্য প্রতিকার ও সুপারিশ

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সময় ব্যবস্থাপনা

পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও বিতরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। সরকার ও এনসিটিবিকে আরও আগেভাগে পরিকল্পনা করে সময়মতো বই বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে।

দেশীয় মুদ্রণশিল্পের উন্নয়ন

দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে সরকারকে বিনিয়োগ করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে বই মুদ্রণের গতি বাড়ানো সম্ভব।

পর্যাপ্ত কাগজ সরবরাহ নিশ্চিত করা

সরকারকে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে কাগজের মজুত রাখতে হবে এবং কাগজ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কছাড় দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি দমন

সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বচ্ছ করতে হবে। দুর্নীতি দমনের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের বিলম্ব এড়ানো যায়।

বিকল্প বিতরণ ব্যবস্থা চালু করা

শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো সম্ভব না হলে অন্তত অনলাইনে বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ সরবরাহ করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সহজেই পাঠ্যবই পড়তে পারে।

সময়মতো তদারকি ও মনিটরিং

পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের প্রতিটি ধাপে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। একাধিক সরকারি সংস্থার সমন্বয়ে একটি নিরীক্ষা কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যারা সময়মতো কাজ সম্পন্ন হওয়া নিশ্চিত করবে।


উপসংহার

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে সময়মতো পাঠ্যপুস্তক বিতরণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫ সালে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে যে সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে, সেগুলোর সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার, প্রশাসন, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ একসঙ্গে কাজ করলে ভবিষ্যতে এই সমস্যার পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব। পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার মান আরও উন্নত করা সম্ভব হবে।


Spread the freedom

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *