তিস্তা নদীর সংকট: চুক্তি ছাড়া মহাপরিকল্পনা কি পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে তিস্তা?

Spread the freedom

তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জীবনরেখা। কিন্তু এই নদী আজ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। উজানে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার, অবকাঠামো নির্মাণ এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে তিস্তা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, মরুকরণ ঘটছে এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। এই সংকট সমাধানে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন দুটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছে: ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারতের সাথে চুক্তি ছাড়া শুধুমাত্র মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে কি তিস্তা নদী পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব?

তিস্তা নদীর সংকটের মূল কারণ

তিস্তা নদীর সংকটের মূল কারণ হলো উজানে ভারতের একতরফা পানি ব্যবস্থাপনা। ভারত গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে, যা শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ফলে তিস্তার পানিপ্রবাহ আরও ব্যাহত হচ্ছে।

১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মার্চের শেষ ১০ দিনে তিস্তার গড় পানিপ্রবাহ ছিল ৬ হাজার ৭১০ কিউসেক। কিন্তু গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণের পর এই প্রবাহ হ্রাস পেয়ে শুষ্ক মৌসুমে মাত্র ২০০-৩০০ কিউসেকে নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতি তিস্তা অববাহিকায় সেচের পানির সংকট, মরুকরণ এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মতো মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করেছে।

মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

তিস্তা নদী পুনরুজ্জীবিত করতে বাংলাদেশ সরকার একটি মহাপরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো তিস্তা নদী খনন করে এর প্রশস্ততা হ্রাস ও গভীরতা বৃদ্ধি করা, ড্রেজিংয়ের মাটি দিয়ে নদীর দুই পাড়ে ভূমি উদ্ধার করা এবং সেই ভূমিতে আবাসন ও শিল্প পার্ক নির্মাণ করা।

তবে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

১. পানিপ্রবাহের অভাব

মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে শুধুমাত্র নদীর গভীরতা বাড়ানো সম্ভব, কিন্তু উজানে পানিপ্রবাহ না বাড়ালে তিস্তা নদী পুনরুজ্জীবিত করা যাবে না। নদীতে দৃশ্যমান পানি আসলে ভূগর্ভস্থ পানি, যা সেচের জন্য ব্যবহার করলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে।

২. বন্যার ঝুঁকি

নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে এবং দুই পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করলে বর্ষাকালে পানিপ্রবাহ বেড়ে গেলে স্রোতের মাত্রা বেড়ে যাবে। এর ফলে নদীর দুই পাড়ের ভাঙনপ্রবণতা বাড়বে এবং বন্যার ঝুঁকি তৈরি হবে।

৩. পরিবেশগত প্রভাব

তিস্তা নদীর দুই পাড়ে বাঁধ নির্মাণের ফলে উপনদী ও শাখা নদীগুলোর সাথে তিস্তার মূলধারার সংযোগ বিঘ্নিত হবে। এতে প্লাবনভূমিতে বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়তে পারবে না, যা পরিবেশগত ভারসাম্যকে ব্যাহত করবে।

তিস্তা চুক্তির প্রয়োজনীয়তা

তিস্তা নদীর সংকট সমাধানের জন্য ভারতের সাথে একটি ন্যায্য ও সমতাপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করা অপরিহার্য। শুধুমাত্র মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তিস্তা নদী পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয়, যদি না উজানে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা যায়।

তিস্তা চুক্তিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন:

১. পানির ন্যায্য বণ্টন

তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা চুক্তির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

২. উজানে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ

গঙ্গা চুক্তির মতো তিস্তা চুক্তিতেও উজানে পানিপ্রবাহ ও গতিপথ পরিবর্তন বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। এছাড়াও, উজানে যেকোনো প্রকল্পের ব্যাপারে নিয়মিত তথ্য-বিনিময়ের বাধ্যবাধকতা রাখতে হবে।

৩. পরিবেশগত প্রবাহ নিশ্চিতকরণ

তিস্তা নদীর ন্যূনতম পরিবেশগত প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে নদীর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।

উপসংহার

তিস্তা নদীর সংকট সমাধানে শুধুমাত্র মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন যথেষ্ট নয়। ভারতের সাথে একটি ন্যায্য ও সমতাপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করা অপরিহার্য। তিস্তা চুক্তি ছাড়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহের অভাব, বন্যার ঝুঁকি এবং পরিবেশগত প্রভাবের মতো সমস্যা রয়ে যাবে। তাই তিস্তা নদী পুনরুজ্জীবিত করতে চুক্তি ও মহাপরিকল্পনা উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।只有这样, তিস্তা নদী তার হারানো গতি ফিরে পাবে এবং উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হবে।


Spread the freedom

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *