
আইনের বদলে জনতা: বাংলাদেশে মব সন্ত্রাস ও শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা

আইন কি কেবল ঘোষণার বিষয় হয়ে গেছে?
বাংলাদেশে এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হিসেবে মব সন্ত্রাস বা গণপিটুনির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়া কোনো নতুন বিষয় নয়, তবে এর ব্যাপকতা ও পারস্পরিক সহিংস মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ এখন এক চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিগত ১০ মাসে দেশব্যাপী মব সন্ত্রাসের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৭৪ জন। এরমধ্যে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসেই ৮৩ জন নিহত হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (MSF)-এর মতো স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী এই পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ। তাদের হিসাব অনুসারে ২০২৩ সালজুড়েও শতাধিক গণপিটুনির ঘটনায় অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে এবং আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। অথচ এই ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি রোধে সরকারের ভাষণ, নির্দেশনা ও নীতিগত অবস্থান থাকলেও বাস্তবে সেসব বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
নূরুল হুদা হামলা: বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি
মব সন্ত্রাসের সর্বশেষ নজির—সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার ওপর সংঘটিত হামলা। রাজধানীর উত্তরায় তাঁর বাসায় গণবিক্ষোভ, হেনস্তা ও পুলিশে সোপর্দের ঘটনাটি নৃশংসতা ও পরিকল্পিত তৎপরতার এক নগ্ন প্রদর্শনী। ঘটনার বিবরণে উঠে এসেছে, অন্তত ৪০-৫০ জনের একটি দল সন্ধ্যায় বাসার দরজা খোলা পেয়ে জোরপূর্বক ভেতরে প্রবেশ করে। নিজেদের ‘নিরাপত্তা কর্মী’ পরিচয় দিয়ে তাঁকে জোরপূর্বক নিচে নামিয়ে এনে অপমান করে, এবং পরে পুলিশের কাছে তুলে দেয়।
ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও হামলাকারীদের প্রতিরোধ বা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের দৃশ্যমান উদাহরণ নেই। যদিও পুলিশ জানিয়েছে—“তিনজন পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল, কিন্তু দুই-আড়াইশ জন মানুষের বিরুদ্ধে তারা একা কী করতে পারতো?”
নূরুল হুদার ওপর হামলার পেছনে রাজনৈতিক উসকানির অভিযোগ উঠেছে। উত্তরা থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যদের নাম এখানে জড়িয়ে আছে, এবং যাদের কেউ কেউ পরে টেলিভিশনে ঘটনার দায় স্বীকারও করেছেন। যদিও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা পরে দাবি করেন, অভিযুক্তদের পদ নেই বা ভিডিওটি সত্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে—এত বড় একটি ঘটনা, এত জন মানুষের উপস্থিতি, ভিডিও ফুটেজ, পুলিশের উপস্থিতি—তবু এখন পর্যন্ত দোষীদের বিরুদ্ধে কী দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
পরিসংখ্যানের ভাষায় একটি ব্যর্থতা
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করলে যে দৃশ্য উঠে আসে তা ভয়াবহ। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় হয়েছে ৪৭৭টি মামলা। মার্চ মাসেই এ সংখ্যা ৯৬। এটি দেখায়—সাধারণ মানুষ কেবল আইন নিজের হাতে নিচ্ছে না, বরং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও আক্রমণের লক্ষ্য বানাচ্ছে।
কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, বিভিন্ন অজুহাতে—গুজব, চুরির সন্দেহ, পারিবারিক বিরোধ কিংবা সামাজিক ক্ষোভ—সবই এখন গণপিটুনির বৈধতা পাচ্ছে। এই আচরণ একদিকে নাগরিক অধিকার হরণের নামান্তর, অন্যদিকে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাঠামোর একটি ঘোরতর ব্যর্থতা।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে—বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কাউকে অপমান করা বা সহিংস আক্রমণের শিকার করা একটি অসভ্য রাষ্ট্রের পরিচায়ক। বিচারপদ্ধতি ও আইনি রাস্তাকে উপেক্ষা করে মব বিচার চালানোর মানে হলো—রাষ্ট্র জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ।
শব্দ আছে, কর্ম নেই
মব থামাতে সরকার, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার হুঁশিয়ারি ও বিবৃতি এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের ঘোষণায় বলা হয়—আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই এবং এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইভাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও কথা দিয়েছেন—এ ধরনের ঘটনা আর সহ্য করা হবে না।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে—এতসব ঘটনার পরেও গ্রেপ্তারের হার কম, বিচারপ্রক্রিয়া ধীর এবং অপরাধীদের মধ্যে ভয়ভীতি নেই। বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপ সীমিত ও প্রতিক্রিয়াশীল।
ড. তৌহিদুল হক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ) সঠিকভাবেই বলেছেন—“যখন পুলিশের সামনে মব সহিংসতা হয়, তখন বোঝা যায় আইন কার্যকর নেই। মব যেন এখন সাংগঠনিক রূপ নিচ্ছে। এটি দমন করা না গেলে যেকোনো সময় যে কেউ এর শিকার হতে পারে।”
রাষ্ট্রের শিথিলতা না শুদ্ধির সময়?
আইন ও গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চলায় মব সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। কিন্তু বাস্তবতা বলছে—এই ব্যাধিটি এখন ভয়ানক ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে কেউ কেউ হয়তো নিজেদের সুবিধার্থে এ ধরণের অপপ্রবণতাকে উসকে দিচ্ছেন, কিন্তু একবার মবের প্রবাহ তৈরি হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
এই বাস্তবতা পরিবর্তন করতে হলে কেবল মুখের কথা নয়, প্রয়োজন—কঠোর আইনি প্রয়োগ, দায়ীদের দ্রুত বিচার, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি যে, তারা কোনো অবস্থাতেই আইনহীনতা সহ্য করবে না।
এটি কেবল আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়—এটি রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। যদি নাগরিকরা মনে করে আইন দিয়ে কিছু হবে না, তখন তারা নিজেরাই আইন হয়ে ওঠে। আর তখনই গঠিত হয় মব—যার হাতে শিকার হতে পারেন যে কেউ। এমনকি আপনারাও।