
চট্টগ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়নে অগ্রাধিকার: অন্তর্বর্তী সরকারের একনেক বরাদ্দের অর্ধেকই বাণিজ্যিক রাজধানীতে

চট্টগ্রাম উন্নয়নে অভূতপূর্ব জোর: অন্তর্বর্তী সরকারের একনেক বরাদ্দে স্পষ্ট প্রতিফলন
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। গত ১০ মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) ১০টি সভায় প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো—এই ব্যয়ের প্রায় অর্ধেকই বরাদ্দ হয়েছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য।
চট্টগ্রামের জন্য প্রস্তাবিত ১৩টি প্রকল্পের মোট ব্যয় ৫০ হাজার ৭৭ কোটি টাকারও বেশি, যার একটি বড় অংশ বৈদেশিক ঋণনির্ভর। এইসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে—কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল-কাম-সড়ক সেতু, বে-টার্মিনাল অবকাঠামো নির্মাণ, পয়োনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং সরকারি আবাসন প্রকল্প।
সরকারি পরিকল্পনাকারীদের ভাষ্যমতে, চট্টগ্রাম দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহের মূল হাব হওয়ায় সেখানে অবকাঠামোগত ঘাটতি পূরণে এই ধরনের বিশেষ অগ্রাধিকার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
প্রকল্পের তালিকায় বৈচিত্র্য ও মেগা স্কেল
চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্প বৈশ্বিক মাপের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- কালুরঘাট রেল-কাম-সড়ক সেতু প্রকল্প: এটির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে প্রায় ১১,৫৬০ কোটি টাকা।
- চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল অবকাঠামো প্রকল্প: প্রায় ১৩,৫২৫ কোটি টাকার এই প্রকল্প মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের ব্যর্থতা পূরণে বিকল্প হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
- পয়োনিষ্কাশন উন্নয়ন: মোট ৫,১৫২ কোটি টাকার প্রকল্পের মধ্যে জাইকা প্রায় ৪,১৪৪ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে।
- কাট্টালী ক্যাচমেন্ট স্যানিটেশন প্রকল্প: প্রায় ২,৭৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প চট্টগ্রামের পানি ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোর পুনর্গঠনে সাহায্য করবে।
- চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প: ৩,৯২১ কোটি টাকার এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ৩,২৬৮ কোটি টাকা।
- সরকারি আবাসন নির্মাণ: ৩৬টি পরিত্যক্ত ভবনে সরকারি আবাসিক ফ্ল্যাট ও ডরমিটরি নির্মাণে বরাদ্দ প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, এইসব প্রকল্প ‘মেগা প্রকল্প’ না হলেও বাস্তবিক অর্থে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং নগর ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘস্থায়ী সুফল আনবে।
চট্টগ্রামকেন্দ্রিক মহাপরিকল্পনা: স্বার্থ না পক্ষপাত?
নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে, এই বরাদ্দ কি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা থেকে, নাকি কোনো পক্ষপাত রয়েছে? পরিকল্পনা কমিশন ও উপদেষ্টারা বলছেন, চট্টগ্রাম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এবং তার নাগরিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। তাই একটি ঘাটতি পূরণের রূপকল্প হিসেবেই এই অগ্রাধিকার নির্ধারিত হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সচিব ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সকল প্রকল্প জাতীয় স্বার্থে নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র।”
অন্যদিকে, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, “আমরা বলেছি মেগা প্রকল্প নেব না। তবে কিছু বাস্তবিক প্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, যাতে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো শক্তিশালী হয়।”
উপসংহার: চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশে উন্নয়নের ঢেউ?
চট্টগ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে সরকার একটি বার্তা দিতে চাচ্ছে—অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব। বন্দরনগরীর পানিবন্দি সড়ক, স্যানিটেশন দুর্বলতা, ট্রাফিক অব্যবস্থা এবং হাউজিং সমস্যাগুলোর সমাধান এ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ঘটলে—চট্টগ্রামই হয়ে উঠবে দেশের আর্থিক ‘গেইম চেঞ্জার’।
তবে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, সময়মতো কাজ শেষ করা এবং স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হবে প্রকৃত সফলতার চাবিকাঠি।