মধ্যপ্রাচ্যের দগ্ধ মানচিত্র: ইরান-ইজরায়েল সংঘাতের বিশ্লেষণ

Spread the freedom

যুদ্ধের পেছনের ঐতিহাসিক ও আদর্শিক কাঠামো

ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যকার শত্রুতা কেবল সামরিক নয়, বরং এটি একটি আদর্শিক ও কৌশলগত সংঘাত। ইজরায়েল একটি ইহুদি রাষ্ট্র, আর ইরান একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র — দুই পক্ষের রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ একে অপরের বিপরীতমুখী। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর ইরান ইজরায়েলকে ‘শত্রু রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ফিলিস্তিনি আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে আসছে। অন্যদিকে, ইজরায়েল ইরানকে ‘আঞ্চলিক হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান তার মিত্র গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে — যেমন হিজবুল্লাহ (লেবাননে), হামাস ও ইসলামিক জিহাদ (গাজায়) — ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ছায়া বিস্তার করেছে, যা পরোক্ষ যুদ্ধকে সরাসরি সংঘাতে রূপান্তর করছে।


যুদ্ধের সাম্প্রতিক রূপ: সরাসরি হামলা ও প্রতিক্রিয়া

২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে শুরু হওয়া সরাসরি সংঘর্ষে, ইরান ও তার প্রভাবাধীন গোষ্ঠীগুলো ইজরায়েলের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এর জবাবে, ইজরায়েলও সিরিয়া, ইরাক এবং ইরানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছে। এই যুদ্ধ এখন আর গাজা উপত্যকার সীমাবদ্ধ নয় — এটি গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুরুতে ইজরায়েলের পাশে অবস্থান নিলেও এখন তারা যুদ্ধের বিস্তার ঠেকাতে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করছে। তবুও, দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে প্রত্যাবর্তনের পথ ক্রমাগত সংকীর্ণ হয়ে উঠছে।


আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও জোট-পরিবর্তনের ইঙ্গিত

এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূরাজনীতির নতুন চিত্র আঁকছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো এখন দ্বিধায় — তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুললেও ইরানবিরোধী সরাসরি অবস্থানে যেতে দ্বিধান্বিত। অপরদিকে, রাশিয়া ও চীন এই সংঘাতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়, বিশেষত ইরানের পক্ষে নীরব সমর্থনের মাধ্যমে। তুরস্ক ও কাতার হামাসের সঙ্গে নৈতিক ঐক্য প্রদর্শন করছে, যদিও তারা সরাসরি জড়াচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার উপস্থিতি একদিকে ইজরায়েলের জন্য আশ্বাস, অন্যদিকে এটি ইরানের জন্য যুদ্ধের যৌক্তিকতা বাড়ায়। প্রতিটি পক্ষ নিজের আঞ্চলিক ও কৌশলগত লাভ নিশ্চিত করতে চাচ্ছে, যার ফলে সংঘাতটি একাধিক মাত্রিক ও বহু-কেন্দ্রিক হয়ে উঠছে।


ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও শান্তির সম্ভাব্য পথ

যুদ্ধ চলমান থাকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে অবকাঠামো, এবং উদ্বাস্তু সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আবারও আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে, যা যুদ্ধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। এই পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বাড়ালেও উভয়পক্ষই আপাতত সমঝোতায় প্রস্তুত নয়। যুদ্ধবিরতির কোনো উপায় আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমান না হলেও, জাতিসংঘ, ওআইসি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর উদ্যোগই হতে পারে শান্তির সেতুবন্ধন। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আস্থা পুনঃস্থাপন এবং আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া সেই সম্ভাবনা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে না। ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ শুধু একটি দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব নয়, এটি গোটা বিশ্বের জন্য একটি বিপজ্জনক বার্তা — অস্থিরতার এই আগুন নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে তা বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্য চিরতরে বদলে দিতে পারে।


Spread the freedom

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *